
ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং ডিভাইস এর প্রয়োগ এবং চালকদের আচরণগত পরিবর্তন
Published Sat 3rd June 2017
আজ থেকে প্রায় বছর ষাট আগে কিংবদন্তী চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্তিক ঘটক সুবোধ ঘোষের গল্প অবলম্বনে একটি দারুণ মর্মস্পর্শী সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন- ‘অযান্ত্রিক’। একজন নিঃসঙ্গ, অকৃতদার ড্রাইভারের জীবন নিয়ে আবর্তিত হয়েছিলো সেটি। মানুষ যতই একা হোক না কেন, বেঁচে থাকার জন্যে একটি অবলম্বন ঠিকই যোগাড় করে নেয়। অযান্ত্রিকেও তেমন মূল চরিত্রটি তার একাকী জীবনে সহায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলো লক্কড়-ঝক্কর মার্কা পুরোনো গাড়ীটিকে। আশেপাশে তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের শিল্প বিপ্লবে শামিল হয়ে দলে দলে চালকেরা নতুন আমদানিকৃত ঝা চকচকে গাড়ি নিয়ে ব্যবসা বিবর্ধনে ব্যস্ত। আমাদের নায়কটি সেরকম নন। তিনি তার অতি পুরোনো ফোর্ড গাড়ীটি পরিচর্যা করে নতুন এবং শক্তিশালী ইঞ্জিনগুলোর সাথে পাল্লা দিতে বদ্ধ পরিকর। আপাত দৃষ্টিতে ‘প্রাণহীন’ গাড়িটিই তার সেরা বন্ধু। যন্ত্রের মাঝে তিনি প্রাণ সঞ্চার করার যে অতি মানবিক উদাহরণ দেখিয়েছেন তা সকল প্রাণময় বস্তুকেই নাড়া দেবে।
এই একবিংশ শতাব্দীর ইট-সিমেন্ট-লোহা-লক্কর-কংক্রিটের অরণ্যে গাড়ীর প্রতি এই ভালোবাসা কতজন ড্রাইভার দেখাতে পারবে, বা আদৌ এমন কেউ আছে কি না তা বেশ সংশয়পূর্ণ একটি জিজ্ঞাসা নিঃসন্দেহে। তবে অতটা না হলেও গাড়ীর সাথে ড্রাইভারদের যে একটি অম্ল-মিষ্টি হৃদ্যতা থাকে তা অস্বীকার করা যায় না।
তবে প্রযুক্তি ব্যাপারটা বড় নির্মম কিছু কিছু ক্ষেত্রে। প্রযুক্তির তোড়ে যেখানে মানবিক আবেগগুলোই হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক, সেখানে যন্ত্রের সাথে সখ্য, তা কি আরো নিম্নগামী হবে না? অপরদিকে এটাও চিন্তা করা যেতে পারে, যান্ত্রিকতাই কি আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়?
সম্পর্ক এবং অসম্পর্কের এসব ভিন্নতর মাত্রা তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করতে গেলে শুধু সংশয়েরই জন্ম দেবে। তাই সে প্রসঙ্গ এখানেই মুলতবী থাক।
যে প্রসঙ্গ টানতে এত বাক্যব্যয় তা হলো ভিটিএস তথা জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের সাথে গাড়ী এবং গাড়ীচালকের সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে আলোচনা করা। কোন গাড়ীতে ভিটিএস ইনস্টল করা থাকলে তা অনেকাংশেই চালকের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে যখন প্রথম প্রথম ভিটিএস ব্যবহৃত হচ্ছিলো তা চালকদের কাছ থেকে খুব ভালো অভ্যর্থনা পায় নি। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এটাকে একটি উটকো আপদ ভেবে মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। তারা নিজেদের স্বাধীনতার প্রতি একে হুমকি মনে করেছিলো। তবে তাদের ভুল ভাংতে খুব একটু বেশি সময় লাগে নি। ভিটিএস এর ভালো দিকগুলো দ্রুতই আবিষ্কার করে সাগ্রহেই তার ওপর থেকে শত্রু তকমা সরিয়ে নিয়েছিলো।
Harsh acceleration, harsh breaking, harsh corning, RPM এসবের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টও চলে আসে। আর স্পিড লিমিট অতিক্রম করলে তো কথাই নেই! ফলে চালককে হতে হয় সতর্ক এবং গাড়ীর প্রতি যত্নশীল।
ভিটিএস এর কাজ শুধুমাত্র গাড়ী চুরি প্রতিরোধ করা বা গাড়ীর অবস্থান নির্ণয় না। গাড়ী কিভাবে চালানো হচ্ছে তার রিপোর্ট প্রস্তুত করতেও এটি পারঙ্গম।
বাংলাদেশেও এই প্রযুক্তিটি বেশ ভালোভাবেই বিকশিত হচ্ছে। এর মধ্যে ফিচার, এবং ইউজার এক্সপেরিয়েন্স মিলিয়ে প্রহরী ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং ডিভাইসকে অনেকেই এগিয়ে রাখছেন রেসে।
একটু বাড়তি সতর্কতা এবং মনোযোগ অবশ্যই কোন মহান ভালোবাসার আখ্যান রচনা করবে না। সুবোধ ঘোষেরা তা নিয়ে কোন গল্প লিখবেন না, ঋত্বিক ঘটকেরা সিনেমা বানাবেন না। তবু যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসাটি যদি একটি মেটাফর হিসেবে ভাবা হয় তবে তা এই কাঠ-কর্কশ নাগরিক জীবনের জন্যে একটি ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করবে এতে সন্দেহ নেই।