চাকাবিহীন একটা পৃথিবীর কথা চিন্তা করলে দেখবেন, যেন সবকিছুই থেমে গেছে। থেমে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। থেমে গেছে কলকারখানা। সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণন না থামলেও, থেমে যাবে পৃথিবীতে মানুষের যোগাযোগ আর কাজকর্ম। অর্থাৎ এই কথা খুব সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, চাকার উপরে ভর করেই আজ মানব সভ্যতা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। তাই ইতিহাসবিদদের মতে চাকা আবিষ্কার হচ্ছে মানব সভ্যতার বিবর্তনের সবথেকে বড় আবিষ্কার। চাকা আমাদের অনেক কাজ সহজ করেছে। চাকা ছাড়া আমদের জীবন হয়ে উঠত জটিল আর শ্রমসাধ্য ব্যপার। রোমানিয়ার কুকুটেনি ট্রিপিলিয়ান সভ্যতায় যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩৬০০ বছর পূর্বে চাকা আবিষ্কারের শুরু হয় বলে মনে করা হয়। উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে চাকা হচ্ছে সবথেকে প্রাচীন ও প্রশংসনীয় আবিষ্কার।
![](https://www.prohori.com/wp-content/uploads/2019/10/invention-of-wheel.jpg)
সম্পূর্ণ মনুষ্য আবিষ্কার
সাধারণত যেকোন আবিষ্কারের পেছনে প্রাকৃতিক উপাদানের অনুপ্রেরণা থাকে। যেমন- মানুষ পাখি দেখে এরোপ্লেন বানানোর কথা চিন্তা করেছিল। আবার লাঠি দেখে কাঁটাচামচ তৈরির চেষ্টা করেছিল, এরকম আরো অনেক। কিন্তু চাকা ছিল একশ ভাগ মনুষ্য চিন্তাশক্তির আবিষ্কার।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা ও শরীরবিদ্যার অধ্যাপক মাইকেল লা বারবেরা ‘আমেরিকান ন্যাচারালিস্ট’ জার্নালের ১৯৮৩ সালের একটি সংখ্যায় লিখেছেন, কিছু অনুজীব যেমন- ব্যকটেরিয়াল ফ্লাজেলা, গুবরে পোকা, আগাছার পোকা যেগুলো মানুষের কাছাকাছি বাস করে,তাদের পাগুলো দেখতে অনেকটা চাকার মতো। এদেরকে চাকাওয়ালা অণুজীবও বলা হয়।
প্রথম আবিষ্কৃত চাকা চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়নি
চাকার আবিষ্কার নিয়ে দুটো প্রচলিত ধারণা হচ্ছে; প্রথমত, পৃথিবীতে মানুষ হাঁটতে হাঁটতে চাকা আবিষ্কারের কথা ভেবেছিল। দ্বিতীয়ত, সহজে যোগাযোগের জন্যই মানুষ চাকা আবিষ্কার করেছিল। তবে এই দুটো ধারণাই ভুল। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের অনেক অনেক পরে চাকার আবিষ্কার হয়েছিল। আর প্রথম চাকার আবিষ্কার যোগাযোগের জন্য তৈরি করা হয়নি।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালে মেসোপটেমিয়াতে কুমোরের কাজে চাকা ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তারও ৩০০ বছর পরে টানা গাড়িতে মানুষ চাকা ব্যবহারের কথা ভেবেছিল।
![](https://www.prohori.com/wp-content/uploads/2019/10/prohori-pottery.jpg)
প্রাচীন গ্রীস আবিষ্কার করল পাশ্চাত্য দর্শন ও ঠেলাগাড়ি
গবেষকগন বিশ্বাস করেন যে, চতুর্থ অথবা ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে ক্লাসিক্যাল গ্রীসে সর্বপ্রথম ঠেলাগাড়ির আবির্ভাব হয়েছিল। তার চার শতাব্দী পরে চায়নাতে ঠেলাগাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, এবং মধ্যযুগে ইউরোপে এই ঠেলাগাড়ির উন্নয়নের পরিসমাপ্তি ঘটে ।এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটে রোমের ইসলামিক বিশ্বের মাধ্যমে। তখন ঠেলাগাড়ি ছিল খুবই ব্যয়বহুল একটি যানবাহন। তখন মানুষ শ্রমসঞ্চয় করার উদ্দেশ্য ৩/৪ দিনের জন্য ঠেলাগাড়ি ভাড়ায় নিত।
শিল্পকলার ইতিহাসবিদ আন্দ্রেয়া মেথিস ১৫০০ শতাব্দীতে একটি হাস্যকর চিত্র খুঁজে পেয়েছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের ঠেলাগাড়ি ঠেলে নরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ভাগ্যের চাকা
‘’ভাগ্যের চাকা’’ কথাটা শুনলে প্রথমে কী মনে আসে? প্রাচীন পুরাণে উল্লেখিত ভাগ্য দেবতার কথা? নাকি অনেকেই বলবেন ক্যাসিনো বা জুয়ার আসরের কথা? উভয় ক্ষেত্রেই চাকার ব্যবহার রয়েছে। প্রাচীন গ্রীক অথবা রোমানদের ধারণা ছিল যে, ভাগ্য দেবী যার উপর সহায় হন ভাগ্যের চাকা তার দিকে ঘুরিয়ে দেন। রোমান পণ্ডিত সিজারিও এবং গ্রীক সাহিত্যিক পিন্ডার দুজনই এই ভাগ্যদেবীর কথা বলেছেন। এমনকি উইলিয়াম শেকসপিয়ার তার কতগুলো নাটকে এই ভাগ্যের চাকা শব্দটি কয়েকবার ব্যবহার করেছেন যেমন- হে ভাগ্য, শুভ রাত্রি, আরেকবার মিষ্টি হেসে তোমার চাকাটা ঘোরাও!
![](https://www.prohori.com/wp-content/uploads/2019/10/12_inch_roulette_set_2048x.jpg)
চাকার প্রতিদ্বন্দ্বী উট!
গ্রীসে চাকায় চালিত ঠেলাগাড়ির ব্যবহার শুরু হলেও, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে চাকার পরিবর্তে উটের ব্যবহার বেশী দেখা যেত। ১৯৭৫ সালে এ.ডি রিচার্ড যিশু খ্রিষ্টের জন্মের আগের ৫০০ এবং ১০০ শতাব্দীর কথা লিখেছেন। তিনি তার ‘দা ক্যামেল অ্যান্ড দা হুইল’ নামক গ্রন্থে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর রাস্তাঘাটের অবনতি সহ, উটের লাগাম আবিষ্কারের কথা লিখেছেন। এসব মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে শিকার এবং যোগাযোগের জন্য চাকার ব্যবহার পরিত্যাগ করলেও, সেচের কাজ, কলের কাজ ও মাটির তৈজসপত্র বানানোর কাজে চাকা ব্যবহার করা হতো।
সবচেয়ে প্রাচীন চাকা ছিল ভারসাম্যহীন।
কয়েক শতাব্দী ধরে, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, গণিতবিদ এবং ক্র্যাকপটস গন এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন, যা একবার চালিয়ে দিলে নিজস্ব গতিতে চলতে ও যতটুকু শক্তি খরচ হবে তার চাইতে বেশি উৎপাদন করতে পারে। এইরকম একটি যন্ত্রের সবচাইতে বড় উদাহরণ হচ্ছে চাকা বা ওয়াটার মিল। যা কোন বিরতি না দিয়ে অবিরাম ঘুরতে থাকে। এই মেশিনের আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো অবিরত চলার জন্য এটি প্রয়োজন মত ওজন পরিবর্তন করতে পারবে। এই চাকার রিমের চারদিকে ভারী বাহু যুক্ত যা নিচের দিকে নামিয়ে ভাঁজ করা যায় অথবা উপরের দিকে উঠানো যায়। তবে নকশা যাই হোক না কেন, এগুলো সবই তাপগতি বিদ্যার প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রগুলো লঙ্ঘন করে। যেহেতু চিরকাল চলমান চাকা আবিষ্কারের কোন কার্যকরী মডেল আবিষ্কৃত হয়নি তাই, মার্কিন পেটেন্ট অফিস এই চাকা আবিষ্কারের দাবীও নাকচ করে দিয়েছিল।
![](https://www.prohori.com/wp-content/uploads/2019/10/mothion-wheel-prohori.jpg)
সর্বপ্রথম পেটেন্ট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট এবং ট্রেডমার্ক অফিসের মতে, মার্কিন পেটেন্ট আইন পাস হওয়ার এক বছর পর, ১৭৯১ সালের ২৬শে অগাস্ট, হয়েছিল নিউ জার্সির প্রিন্সটনের জেমস ম্যাককম্ব নামে চাকা বিষয়ক সর্বপ্রথম পেটেন্ট জারি করা হয়েছিল। ম্যাককম্ব কলকারখানায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহারের জন্য অনুভূমিক ও ফাপা একটি চাকার আবিষ্কার করেছিলেন। যদিও পেটেন্ট অফিসারগণ ম্যাককম্বের নামে পেটেন্ট জারি হবার ব্যাপারটি শিকার করেন, কিন্তু এই পেটেন্টের মুল নথিপত্র ১৮৩৬ সালের এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
খেলনায় চাকার ব্যবহার
মেক্সিকোর ভেরাক্রুজে ১৯৪০ সালে, প্রত্নতাত্ত্বিকগন মাটি খুঁড়ে কিছু খেলনা খুঁজে পান । যে খেলনা গুলো ছিল সিরামিকের তৈরি কুকুর ও অন্যান্য প্রাণী। এদের পায়ের বদলে লাগান ছিল চাকা। উত্তর আমেরিকার স্থানীয় মানুষরা ইউরোপিয়ান সেটলারদের আগমনের আগ পর্যন্ত পরিবহনের জন্য চাকা খুব একটা ব্যবহার করত না।
![](https://www.prohori.com/wp-content/uploads/2019/10/il_794xN.1748501700_kxrl.jpg)
এখন কোথাও যাওয়ার জন্য আমরা চাকার উপরেই বেশি নির্ভরশীল। রিকশা থেকে শুরু করে উন্নত প্রযুক্তির সুপার কার, সব গাড়িই চাকার উপর নির্ভরশীল। চাকা ছাড়া যেন এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। চাকা ছাড়া মানুষের জীবনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। শুধু যে যোগাযোগ, তা নয়। চাকা এগিয়ে নিয়েছে মানবসভ্যতাকে। ইতিহাসকে, উন্নতিকে, প্রযুক্তিকে নতুন মাত্রা দেয়ার পেছনে চাকার ভূমিকা অতুলনীয়!