ছোটবেলায় আমরা কমবেশি সবাই My Hobby শিরোনামের একটা প্যারাগ্রাফ বা রচনা পড়েছি। সেখানে একেকজন একেক রকম শখের কথা লিখতো। কারো শখ ছিল বাগান করা, কারো শখ ডাকটিকিট সংগ্রহ করা আবার কেউ লিখতো দেশ বিদেশের কয়েন সংগ্রহ করাই তাদের শখ। কিন্তু কারো প্রিয় শখ হিসেবে গাড়ি সংগ্রহ করা- এমনটা কি কখনো দেখেছেন বা শুনেছেন?
আজ এমনই একজন শৌখিন মানুষের কথা বলব, যার শখই হচ্ছে গাড়ি সংগ্রহ করা। পুরোনো সব গাড়ি দূর দূরান্ত থেকে সংগ্রহ করে, বছরের পর বছর ধরে তার শখ মিটিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশেরই একজন গাড়ি সংগ্রাহক মাহমুদুল ফারুক! তার সংগ্রহের গাড়িগুলো একে তো ক্লাসিক গাড়ি, তার উপরে গাড়িগুলোর সাথে মিশে আছে অনেক ইতিহাস!
ঢাকার উত্তরার মইনার টেকে মাহমুদুল ফারুকের খামারবাড়িতে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে একটা ছোট গেট, এই গেট পার হয়ে সামনে আরো একটা গেটের ওপারেই দেখা যাবে সারি সারি পুরনো দিনের গাড়ি সাজানো আছে। কোন কোন গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছেন দু একজন লোক।
গাড়ির নেশা যেভাবে শুরু
মাহমুদুল ফারুকের গাড়ির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তার বাবাকে দেখে। তার বাবার মোসলেহ উদ্দিনেরও ছিল গাড়িপ্রীতি। প্রাথমিকভাবে বাবার থেকে এই শখ পেলেও তার গাড়ি সংগ্রেহের শখ আরো প্রবল হয় তিনি যখন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পড়তে গিয়েছিলেন। চিটাগাং কলেজিয়েট থেকে মেট্রিক এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করে মাহমুদুল ফারুক উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান জার্মানিতে। সেখানে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা গাড়ি সংগ্রহ করে।
এই অন্যরকম শখ তার মধ্যেও জেঁকে বসলো। তারপর থেকে তিনি গাড়ি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন এবং উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে, নেমে পড়লেন গাড়ি সংগ্রহ করার শখ পূরণে।
প্রথম গাড়ি সংগ্রহ
গাড়ি জমানোর শখ বুকে নিয়ে ১৯৭৭ সালে দেশে ফেরেন ফারুক। এসেই চট্টগ্রামের নজিরহাটে দেখলেন ১৯২৮ মডেলের একটি ফোর্ড ব্র্যান্ডের গাড়ি। চান্দের গাড়ির নাম শুনেছেন আপনারা অনেকেই কিন্তু আসল চান্দের গাড়ি কোনগুলো তা অনেকেই জানেন না। এই ফোর্ড ব্র্যান্ডের গাড়িগুলোই আদি চান্দের গাড়ি। এই গাড়ি দিয়েই শুরু হলো ফারুকের গাড়ি কালেক্ট করার শখ পূরণ।
গাড়ি যেন ইতিহাস বলে
মাহমুদুল ফারুকের সংগ্রহে যেসব গাড়ি আছে সেসব গাড়ি যেন ইতিহাসেরই কথা বলে। তার সংগ্রেহের গাড়িতে মিশে আছে দেশ বরেণ্য অনেক বাংলাদেশির ছোঁয়া। বাংলাদেশের প্রথম তিন রাষ্ট্রপতি এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ব্যবহৃত একটি গাড়িও ফারুকের কালেকশনে জায়গা করে নিয়েছে।
শেভরোলেট ১৯৫৬ মডেলের একটি গাড়ি, যার নাম্বার চট্টগ্রাম ক ২১৩৩। এই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম বেড়াতে গেলেই ব্যবহার করতেন। তার আগে তিনজন রাষ্ট্রপতিও এই গাড়ি ব্যবহার করেছেন। এই গাড়ির সাথে মিশে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও! এই গাড়িটি মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের সরঞ্জাম আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে একটা গ্লাস ফুটো হয়ে গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে সেটিকে আর মেরামত করেন নি তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত গাড়ি যেমন আছে, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়িও আছে ফারুকের কালেকশনে। ব্রিটিশ, জাপানিজ আর্মিদের ব্যবহার করা গাড়িও দেখা যাবে ফারুকের সংগ্রহশালায়। আমেরিকা, জাপান, ইতালি, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের গাড়ি আছে তার উত্তরখানের খামারবাড়িতে। ব্র্যান্ডগুলো সব পুরনো দিনের ক্ল্যাসিক। শেভরোলেট, অস্টিন, ফিয়েট, রোলস রয়েলস, টয়োটা মারসিডিজ বেঞ্জ, ভক্সওয়াগন, মরিস মাইনর, জাগুয়ার, মাজদা সহ আরো কিছু ব্র্যান্ডের ক্ল্যাসিক মডেলের গাড়ি সংগ্রহ করেছেন তিনি।
বর্তমানে তার সংগ্রহে প্রায় ৬০ টি গাড়ি আছে। এগুলো সংগ্রহ করা তার শখ তো বটেই, কোন কোন গাড়ি তিনি নিজেও ব্যবহার করে থাকেন। যদি মেরামত করার দরকার পড়ে তাহলে মেরামত করেই নিজের জন্য ব্যবহার করেন মাঝে মাঝে। শেভরোলেট ১৯২৭ মডেলের একটি চার সিলিন্ডারের গাড়ি তিনি ঢাকার রাস্তায় চালিয়েছেন অনেকদিন। ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকার প্রথম ভিন্টেজ কার র্যালিতেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।
আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে তার বিয়ের সময়েও এই গাড়িতে করে তিনি বরযাত্রী হিসেবে গিয়েছিলেন। অতএব বুঝাই যাচ্ছে ভিনটেজ গাড়ির প্রতি ফারুক সাহেবের প্যাশন কত গভীর!
পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় কিছু গাড়িও আছে মাহমুদুল ফারুকের কালেকশনে। শেভরোলেট পাইথন ১৯৩১ মডেলের গাড়ি সারা পৃথিবীতে আছে মাত্র ৫ টি। এর মধ্যে একটি আছে ফারুকের সংগ্রহশালায়।
বাংলাদেশে আসা সর্বপ্রথম ট্রাক্টরটি আছে ফারুকের কালেকশনে।ট্রাক্টরটি ছিল তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়কার মানে প্রায় ত্রিশ দশকের দিকের। কুষ্টিয়ার একজন জমিদারপুত্র এই ট্রাক্টর বিদেশ থেকে কিনে এনেছিলেন। এটি দিয়ে চাষবাস করা শুরু হলেও একদিন জমিদারপুত্র মারাযায়। পুত্রশোকে দিশেহারা জমিদার এই ট্রাক্টরে মাথা টুকে টুকে মারা গিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করতো এটি অভিশপ্ত ট্রাক্টর। পরে এটিকে ধান ভাঙার মেশিন হিসেবে বিক্রি করে দিলেও হাত ঘুরে এটি চলে আসে মাহমুদুল ফারুকের হাতে।
শুধু গাড়ি না আছে বাইক আর উড়োজাহাজ
মাহমুদুল ফারুকের সংগ্রহশালায় গাড়ি তো আছেই, আছে কিছু পুরোনো দিনের ক্লাসিক বাইকও! ইতালিয়ান ভেসপা, ইংল্যান্ডের ট্রায়াম্প, রয়্যাল এনফিল্ড, ল্যাম্পব্রাটা ডুকাটির মতো পুরনো বাইকের একটা ছোট সংগ্রহ আছে ফারুক সাহেবের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিজ আর্মির বিরুদ্ধে ব্রটিশ আর্মিদের ব্যবহার করা ইন্ডিয়ান ইউ এস ১৯৪২ মডেলের একটা বাইকও আছে।
গাড়ি হোক বা বাইক, কোন গাড়ি সংগ্রহে আসলেই সেটিকে মেরামত করতে হয়। মেরামতের কাজটিও দেখাশোনা করেন ফারুক সাহেব। তার মইনার টেকের সংগ্রহশালায়ই হয় মেরামতের কাজ। কোন গাড়ির কোন পার্টস লাগবে তা তিনি খুঁজে খুঁজে বের করেন। কখনো কখনো গাড়ির পার্টেসের জন্য তাকে দেশের বাইরেও খোঁজ করতে হয়। তাও পিছপা হন না তিনি। যন্ত্রাংশ খুঁজে খুঁজে ঠিকই মেরামত করে ফেলেন সংগ্রহের গাড়ি!
মাহমুদুল ফারুক যখন এসব গাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটেন বা কোন গাড়িতে চড়েন তখন তার মনেহয় এই গাড়িগুলোর ইতিহাস তার সামনে ভেসে ওঠে। হয় সংগ্রহশালায় হাঁটতে হাঁটতে হয় চোখ বুজে কল্পনা করেন ফোর্ডে চড়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু! তিনি তার গাড়িগুলোকে ভালবাসেন, এগুলোর নিয়মিত দেখাশোনাও করেন। আপনি আপনার গাড়ির ঠিকঠাক দেখাশোনা করছেন তো? যদি একা একা গাড়ির সব খবর রাখতে হিমশিম খান, তো ব্যবহার করতে পারেন প্রহরী ভেইকেল ট্র্যাকার।