গত ইদ-উল-ফিতরের সময়, ফেসবুকে অভিনেত্রী জয়া আহসানের সাথে একজন ভদ্রলোকের ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছিলো। আপনি কি জানেন কে সেই ভদ্রলোক? অনেকেই হয়ত ভেবেছিলেন তিনি জয়া আহসানের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ। কিন্তু না, সে আসলে জয়া আহসানের কাজিনের স্বামী। তবে তার আরো একটা পরিচয় আছে। সেই পরিচয়ের আগে একটু ক্রিকেটার তামিম ইকবালের ফেসবুক পেইজের দিকে নজর দেয়া যাক।
ক্রিকেটার তামিম ইকবাল খানের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজ থেকে, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আন্তর্জাতিক কোন মোটর স্পোর্টস ইভেন্টে বিজয়ী হওয়ার জন্য একজন রেসারকে অভিনন্দন জানিয়ে ওই পোস্টটি দেয়া হয়েছিল। তামিম ইকবাল ফেইসবুক পোস্টে যাকে বিজয়ী হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তিনিই জয়া আহসানের সাথে ছবিতে থাকা ভদ্রলোক। তিনি তামিম ইকবালেরও বন্ধু। নাম অভীক আনোয়ার।
ভারতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল মোটর ইভেন্ট, ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপে শিরোপা জিতে, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কোন আন্তর্জাতিক মোটর স্পোর্টস কম্পিটিশনে জয়ী হবার গৌরব অর্জন করেছেন অভীক আনোয়ার। একই ইভেন্টে এর আগে দুইবার অংশগ্রহণ করে সফলতার মুখ দেখতে পারেন নি। কিন্তু হাল না ছেড়ে আবারো অংশ নিয়েছেন। আর তাতেই বাজিমাত।
যেভাবে মোটর রেসিং শুরু
অভীক আনোয়ার এফ আই আর স্বীকৃত একজন পেশাদার রেসার। তার রেসার হবার স্বপ্ন শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালের দিকে। টিভিতে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং দেখতে দেখতেই তিনি রেসার হবার স্বপ্ন বুনেছিলেন। এই স্বপ্নকে বুকে লালন করে পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশের মাটিতে। কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিক্সে পড়াশোনার জন্য ডাক পেয়েছিলেন তিনি। আর তাতেই তার স্বপ্ন পূরণের দরজা খুলে গিয়েছিল।
আমাদের দেশে যারা মোটর রেসিং এর প্রতি আগ্রহ দেখান, তাদের প্রথম বাঁধা হচ্ছে এই খেলার জন্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। এখানে এই খেলার জন্য নেই কোন দক্ষ প্রশিক্ষক, নেই কোন রেসিং ট্র্যাক। তাই বাংলাদেশের মাটিতে নিজেকে একজন রেসার হিসেবে গড়ে তোলা খুবই কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ।
প্রবাসে পার্ট টাইম জব করে রেসিং শেখা
কানাডায় পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখলেন একটু কষ্ট করলেই তিনি রেসিং ট্রেনিং নিতে পারবেন। কারন কানাডায় বাংলাদেশের মতো এতো বাঁধা নেই। সেখানে প্রশিক্ষক আছে,, রেসিং ট্র্যাক আছে। সেখানে একমাত্র বাঁধা হচ্ছে টাকা। যেহেতু মোটর রেসিং একটি ব্যয়বহুল খেলা, তাই রেসার হতে হলে লাগবে অনেক টাকা। কানাডায় পড়াশনার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করতেন তিনি। পার্ট টাইম জব থেকে আয় করা টাকা তিনি জমিয়ে রাখতেন রেসার হবার জন্য। এমনও দিন গেছে অভীকের, মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো হাড় কাঁপানো শীতে পিজ্জা ডেলিভারির কাজ করেছেন শুধুমাত্র টাকা জমিয়ে রেসিং ট্র্যাকে নিজের পদচ্ছাপ আঁকার জন্য।
এভাবে অমানবিক পরিশ্রমের মাধ্যমে রেসিং এর জন্য ২০০৯ সাল পর্যন্ত টাকা জমিয়েছিলেন তিনি। জমানো টাকাকে পুঁজি করে সেই বছরই তিনি কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত রেসিং ট্র্যাক টরন্টো মোটর স্পোর্টস পার্কে প্র্যাক্টিস শুরু করেন। এই রেসিং ট্র্যাকে প্র্যাক্টিস করার জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। অভীকের ভাষ্যমতে প্রতি দুই ঘন্টা প্র্যাক্টিসের জন্য গুনতে হয় প্রায় ১৪ হাজার টাকা! তাও আবার নিজের গাড়ি নিয়ে যেতে হয়।
টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ
রেসিং টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার জন্যও কম অর্থ খরচ করতে হয়নি অভীকের। রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য দরকার সার্টিফিকেট এবং লাইসেন্স। ভারত থেকে ৫০ হাজার টাকায় রেসিং সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। এই সার্টিফিকেট পাওয়ার পর রেসিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হয়। রেসিং লাইসেন্স পেতে খরচ হয় রেসিং সার্টিফিকেটের চাইতে দ্বিগুণ! প্রায় এক লক্ষ্ টাকা! এই লাইসেন্স নিয়েই যেকোনো রেসার যেকোনো মোটর রেসিং টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারেন।
২০১৪ সালে কানাডা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকার র্যালি ক্রস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতায়ও প্রথম হয়েছিলেন অভীক। কিন্তু সেটা কোন পেশাদার রেসিং প্রতিযোগিতা ছিল না। তাই তিনি খোঁজ করতে লাগলেন কোথায় পেশাদার রেসিং অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৭ সালে সেরকমই একটি পেশাদার মোটর রেসিং ইভেন্ট ভারতের এমিও কাপে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন। সেই প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছিলেন তিনি। আর তার জন্য তাকে খরচ করতে হয়েছিল ১২ লক্ষ টাকা! এই টাকায় মোট ১১ রাউন্ড রেস করা যাবে। আর বাকি যেসব খরচ সেসবও নিজেকে বহন করতে হবে। অর্থাৎ প্রতি রাউন্ডে প্রায় এক লাখ টাকা লেগে যায়। আর যদি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে হয় তাহলে খরচ হবে প্রায় ৩০-৩২ লাখ টাকা!
সফলতা
একটা রেসিং টুর্নামেন্ট জিততে হলে দরকার পেশাদার রেসিং কোচ। ২০১৭ থেকে ২০১৯ এই দুইবছর তার নিজের কোন কোচ ছিল না। তাই সফলতা পেতেও দেরি হয়ে গেছে।
কোচিং এর জন্য ভারতেরই একটি রেসিং টিম মোমেন্টাম মোটর স্পোর্টস এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই প্রশিক্ষণ এবং দিক নির্দেশনা পেয়ে তিনি এই বছর এই সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন।
অনেকেই হয়ত ভাবছেন, মোটর রেসিং এর জন্য এত টাকা তিনি কীভাবে জোগাড় করেন? মূলত গাড়ি নিয়েই তার সব কাজ কারবার।তার নিজের গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। কার হাউজ নামক গাড়ি বিক্রয়ের একটা দোকান আছে। গাড়ি ব্যবসা থেকে আয় করা লাভের টাকা জমিয়েই তিনি রেসিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
যারা রেসিং করতে চান তাদের জন্য অভীকের পরামর্শ
তবে সবার তো আর অভীকের মতো সচ্ছলতা নেই। তাই যারা মোটর রেসিং করতে আগ্রহী তাদের জন্য অভীকের পরামর্শ হচ্ছে- প্রথম প্রথম সিমুলেটরে রেসিং প্র্যাক্টিস করা। তিনি নিজেও এখনো সিমুলেটরে রেসিং প্র্যাক্টিস করে থাকেন।
অভীক বলেন, আপনার যদি আগ্রহ থাকে রেসিং করবেন তাহলে একটা দামী মোবাইল না কিনে একটা সিমুলেটর কিনেন। এটা হচ্ছে প্রথম ধাপ। এরপর গো কার্টিং রেস করতে পারেন। আর এই দুইধাপ পার হয়ে যেতে হবে রেসিং ট্র্যাকে আর রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপে।
যে দেশে গাড়ি চালানোর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যাম ঠেলতে হয়, সেই দেশেরই একজন তরুণ বিশ্বের বুকে রেসার চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গৌরবের। ক্রিকেটের পাশাপাশি বাংলাদেশের নাম অন্যান্য স্পোর্টেস সাথেও যুক্ত হচ্ছে। তবে দেশ যেটাই হোক না কেন, কারো মধ্যে যদি প্রতিভা থাকে, এবং সেই প্রতিভার খোঁজ যদি সেই ব্যক্তি পেয়ে থাকেন, তাহলে প্রতিভাকে পরিচর্যা করলে সাফল্য এসে ধরা দিবেই। যেন প্রতিভা দিয়ে সফলতাকে ট্র্যাক করে নিয়েছেন নিজেই। অভীক আনোয়ার তারই প্রমাণ।