প্রহরী জিপিএস ট্র্যাকার

পড়তে লাগবে: 4 মিনিট

রাব্বি আপা: হার না মানা এক গাড়ি মেকানিকের গল্প!

যে রাধে সে চুলও বাঁধে- এই বিখ্যাত উক্তিটি প্রমান করে যাচ্ছেন এই যুগের নারীরা। বর্তমানে নারীরা সর্বজয়ী। সংসার যুদ্ধে জয়ী আর চাকরীর ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছে । সারাদিন বাইরে কাজ করে এসে বাচ্চা সামলানো, সংসারের যাবতীয় কাজ নিপুন হাতে করা একমাত্র নারীরাই করছে ।  পুরুষ যা পারে নারী তা পারেনা এই যুক্তির খণ্ডন করলেন এক বিস্ময়কর নারী মেকানিক ‘রাব্বি আপা’ ও তার জীবনের গল্প। মেকানিক হিসেবে একজন নারী ব্যাপারটা বাংলাদেশে এমনকি বাইরের দেশগুলোতেও খুব একটা দেখা যায়না। এসব প্রথাগত  রীতিনীতি পেছনে ফেলে, কঠোর পরিশ্রমের এই কাজে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া  ‘রাব্বি আপা’ এখন একজন সফল নারী মেকানিক। বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য একটি অনুপ্রেরনা হতে পারে মেকানিক রাব্বি আপা । আসুন তাহলে জেনে নেই সংগ্রামী এক নারী মেকানিক রাব্বি আপার শৈশব ও কর্মজীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য।

শৈশব যখন ধূসর।

পুরো নাম -রাবেয়া সুলতানা। তাকে সবাই  ‘রাব্বি আপা’ হিসেবেই জানে।

জন্মস্থান –দিনাজপুর।

২০০৫ সালের  এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও রেজিস্ট্রেশনের টাকা জোগাড় করতে পারেননি বলে পরীক্ষা দেয়া হয়নি তার। বাবা আব্দুল আজিজ ছিলেন একজন সবজি বিক্রেতা । ছয় ছেলেমেয়ে সহ আট সদস্য নিয়ে সংসার সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হতো তাকে। অর্থাভাবে না খেয়ে থাকতে হতো তাদের।  রাবেয়া জানান তার কখনোই ইচ্ছা ছিলনা মেকানিক হবার। কিন্তু পরিবারের সবাইকে তখন না খেয়ে থাকতো। ভাইয়েরা সংসারের খরচ দিত না। তার ভেতরে এক ধরনের জেদ কাজ করতো । তিনি ভাবতেন বড় হয়ে তিনি সংসার চালাবেন এবং বাবা মায়ের সব অভাব দূর করবেন।

ইঞ্জিনের গায়ে হাত দিয়েই বলতে পারেন গাড়ির কি সমস্যা।

জীবন যুদ্ধে জয়ী যখন

২০০৫ সালেই কেয়ার বাংলাদেশ থেকে একজন মাঠকর্মী রাব্বির বাসায় যান । তারা গরীব মেয়েদের কাজ শেখাবে বলে জানায়। রাবেয়া দিনাজপুরেই গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। এরপর প্রায় নয়মাস গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণের পর কাজ শুরু করেন । প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর একটি মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয় তাদের। কিন্তু সেখানে তিনি টিকতে পারলেন না। পরে কেয়ার থেকে তাকে মেকানিক হিসেবে যোগদানের কথা বললে তিনি সে সুযোগটি লুফে নেন। ধীরে ধীরে কাজে আরো একটু পারদর্শিতা বাড়ালেন। মেয়ে বলে কি থেমে থাকলে চলে ? যেমন অনেক গাড়ির পার্টস ভারী হয় যেগুলো একা কোন মেয়ের পক্ষে সরানো সম্ভব না ! সেসব কাজে তিনি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যান নি কখনো।  ওয়ান্ডার ওমেন যেমন শক্তিশালী এক হাত দিয়ে বড় বড় সব গাড়ি তুলে ফেলে আমি আমার কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি ঠিক তেমনি রাব্বি এক হাতে নিমিষেই সেরে ফেলছেন বড়বড় সব গাড়ি ।

গাড়ির ফিল্টার পাল্টানো, ব্রেকের কাজ, মবিল বদলানো সব কাজ এখন তিনি আনায়াসে করতে পারেন। মোটর সাইকেল থেকে শুরু করে জীপ, প্রাইভেট কার সব গাড়ির কাজই তিনি নিমিষেই করে ফেলেন।  প্রথম প্রথম অনেকে তার কাছে গাড়ির কাজ করাতে অনীহা প্রকাশ করতো। কিন্তু কেয়ারের নিয়ম হচ্ছে নারী-পুরুষ কোন ভেদাভেদ নেই । পরে যখন সবাই দেখল তিনি কাজ বেশ ভালোভাবে করেন, দ্বিতীয়বার তার কাছে এসে আবার বলতো গাড়ি সারবার কথা।

১৩ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন কেয়ারের সঙ্গে।

কেয়ারের ম্যানেজার জানান, বর্তমানে তাদের কর্মীর সংখ্যা ১২ জন। তার মধ্যে একমাত্র রাব্বিই নারী কর্মী। রাব্বির প্রশংসা করে তিনি বলেন , তিনি একমাত্র নারী মোটর মেকানিক । অত্যন্ত দক্ষ কর্মী তিনি ।  ইঞ্জিনে কিংবা চাকায় হাত দিলেই বুঝতে পারেন  গাড়ির কি সমস্যা।  অর্থাৎ রাব্বি হচ্ছে গাড়ির ডাক্তার।  তিনি আরো বলেন, তিনি শুধু মেকানিকের কাজই নিখুঁতভাবে করেন না অফিসের অন্যান্য ফাইলের কাজেও সাহায্য করেন তিনি। কোন কাজে কখনো ‘না’ বলেন না ।  সব কাজকেই তিনি সাদরে গ্রহণ করার মন মানসিকতা রাখেন। সব মিলিয়ে চমৎকার একজন কর্মী তিনি।

২০০৬ সাল থেকে  কাজ করে চলছেন কেয়ারের সঙ্গে।

কয়েক বছর আগে দিনাজপুরে ব্যাংকের একটি কাজে গিয়েছিলেন রাব্বি। হতবাক  ব্যাংক ম্যানেজার কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, একজন নারী হয়েও কীভাবে মেকানিক হয়। বাধ্য হয়ে পরিচয়পত্র দেখাতে হয়েছিল রাব্বিকে। এরকম অনেক মানুষই আছে যারা রাব্বির পেশা নিয়ে অবাক হন , তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। সেসব বাঁকা চোখকে উপেক্ষা করেই রাব্বি এগিয়ে চলেছেন সাফল্যের দিকে।

পরিবার ও দায়িত্ব 

চার বছরের একটি সন্তান রয়েছে রাব্বির। তার স্বামী একটি এনজিওতে চাকরি করতেন কিন্তু এখন আর  করেন না। এখন তিনি সন্তানকে সময় দেন। প্রত্যেকমাসে ওভারটাইম সহ প্রায় ৪৫,০০০ টাকা বেতন পান রাব্বি। তার টাকায় দুটি পরিবার চলে । একটি পরিবার তার স্বামী , সন্তান আরেকটি গ্রামে বাবা, মায়ের । নিয়মিত ট্যাক্সও দেন তিনি। সামান্য হেসে তিনি  বলেন , বেতন এভাবে বলার কারণ হচ্ছে, অন্যান্য মেয়েরাও সমাজের তথাকথিত গণ্ডি পেরিয়ে যেন এই পেশায় যোগদানে আগ্রহী হয়। নিজগ্রামে গেলে সবাই তাকে দেখতে আসে আর তার পেশা সম্পর্কে জানতে চায়, অবাক হয়। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালোই লাগে রাব্বির। অনেকে আবার বলে বসে, কেন পুরুষমানুষের কাজ করো?  তখন রাব্বি হাসিমুখেই সব প্রশ্নের উত্তর দেন।

মেকানিক রাব্বি আপা একজন পরিশ্রমী কর্মী।

রাব্বি আরো বলেন, কাজ শেষে বাসায় ফিরলে আমার শক্তি দ্বিগুণ হয়ে যায়। সবকিছুর মাঝে আমি একজন মা, একজন স্ত্রী , তাই না?

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ভবিষ্যতে তার ইচ্ছা নিজের শহর দিনাজপুরে একটি নিজস্ব মেকানিক কারখানা স্থাপনের। আর তার ছেলেকে অ্যারনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বানানো। আশা করি তার স্বপ্নগুলো  একদিন বাস্তব রূপ নিবে।

বাস্তবতাই মানুষকে অনেক শিক্ষা দেয়। ছোটবেলায় দুঃখ , কষ্ট পেয়ে নজরুল হয়েছিলেন দুখু মিয়া তথা বিদ্রোহী কবি। আর অভাবের সংসারে দুমুঠো অন্ন যোগাতে রাবেয়া হলেন মেকানিক রাব্বি আপা। আর রাব্বি আপার মত মানুষই হচ্ছে আমাদের আদর্শ,  সামনে এগিয়ে চলার প্রেরনা। চরম দারিদ্রতাই যখন মানুষকে স্বাবলম্বী হতে শিক্ষা দেয়, সমাজের কোন বাধাই তখন তাদের আটকে রাখার ক্ষমতা রাখেনা। অদম্য মানসিক শক্তি , আত্মবিশ্বাস , কঠোর পরিশ্রম দিয়ে যেকোন মানুষ পৌঁছে যেতে পারে তার লক্ষ্যমাত্রার চূড়ান্ত শিখরে। মেকানিক রাব্বি আপার গল্প আমাদের এই শিক্ষাই দেয়।

    গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী সম্পর্কে জানতে

    Share your vote!


    এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
    • Fascinated
    • Happy
    • Sad
    • Angry
    • Bored
    • Afraid

    মন্তব্যসমূহ

    Scroll to Top