প্রহরী জিপিএস ট্র্যাকার

পড়তে লাগবে: 6 মিনিট

এম আর তুষার: মাদ্রাসা শিক্ষার্থী থেকে বাংলাদেশের প্রথম ফর্মুলা রেসার!

গাড়ি রেসিং সম্পর্কে যাদের আগ্রহ আছে তারা নিশ্চই ফর্মুলা ওয়ান রেসিং নিয়ে কম বেশি জেনে থাকবেন। আর যারা জানেন না, তারা বিভিন্ন স্পোর্টস চ্যানেলে কখনো না কখনো পিচঢালা রেসিং ট্র্যাকে চার চাকার ঝড় তুলতে দেখেছেন। মাইকেল শুমাখার, লুইস হ্যামিলটনের মতো ফর্মুলা রেসার, রেসিং ট্র্যাকের একেকজন কিংবদন্তী। ফেরারি, মার্সিডিজের মতো বিখ্যাত ব্র্যান্ডের রেসিং কার নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান রেসিং ট্র্যাক!

কখনো কি ভেবেছেন, সব কিংবদন্তী রেসাররা যেভাবে রেসিং ট্র্যাকে গতির খেলা দেখান, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশি কোন রেসার গতির ঝড় তুলতে পারে? হ্যাঁ, অবাক করার মতো হলেও সত্য যে, ফর্মুলা রেসিং ট্র্যাকে রেসিং কার নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য রেসারদের সাথে নিজের নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ মাহফুজুর রহমান তুষার।

২০১৩ সালে তুষার আনুষ্ঠানিকভাবে ফর্মুলা রেসিং প্রতিযোগিতায় নাম লিখান এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কোন ফর্মুলা রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। শাহ সিমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় তুষার ভারতে অনুষ্ঠিত ফর্মুলা ফোর রেসিং কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

গতি নিয়ে তুষারের আগ্রহ তার কথার মধ্যেই প্রকাশ পায়। তিনি বলেন,

“গতি জিনিসটার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। যারা গতি ভালবাসে গতিময় থাকতে ভালবাসে তাদের চোখের সামনে একটা স্পিডমিটার রাখুন। দেখবেন সে অস্থির হয়ে উঠেছে। তাদের মাথায় শুধু একটা কথাই খেলা করবে; নিজের সীমাকে আরো প্রসারিত করার আকাঙ্ক্ষায় তারা বিভোর হয়ে উঠবে”

তাই বলে, তুষার যে খুবই চঞ্চল এবং অস্থির তা কিন্তু নয়। তিনি খুবই শান্তশিষ্ট একজন তরুণ। শুধু গাড়ির স্পিডমিটারের সামনে বসলেই তিনি এই রোমাঞ্চ অনুভব করেন। তার মতে এটা খারাপ কিছু নয়। এই রোমাঞ্চকর অনুভূতিটা তুষারের কাছে বেশ উপভোগ্য এবং খুবই প্রাকৃতিক একটি অনুভূতি!

রেসার হবার অনুপ্রেরণা

একজন রেসার যেভাবে ফর্মুলা রেসার হয়ে ওঠেন, তুষারের ফর্মুলা রেসার হবার গল্প ততটা সহজ নয়। ফর্মুলা রেসারদের রেসার হওয়ার শুরু তাদের প্রাথমিক বয়স থেকেই শুরু হয়। অনেক রেসারই আছেন ৬-১০ বছর বয়সের মধ্যেই রেসার হবার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে যান। তারা বছরের পর বছর কঠিন অধ্যবসায়ের পর একজন পরিপূর্ণ রেসার হয়ে ওঠেন।

কিন্তু তুষারের ফর্মুলা রেসার হয়ে ওঠার গল্পটা সেরকম নয়! সে গতানুগতিকভাবে রেসার হয়ে ওঠেনি। তার রেসার হবার অনুপ্রেরণা ছিল অন্যরকম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার আগে সে ছিল একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। অন্য সব শিক্ষার্থীদের মতো তার এত সুযোগসুবিধা ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর তিনি ভর্তি হন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সাব্জেক্টে। সেই থেকে গাড়ির প্রতি আগ্রহ এবং ভালোবাসার শুরু।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তার গাড়ির প্রতি আগ্রহ তার ভাইয়ের চোখে পড়ে। তাই তার ভাই দেশ বিদেশের নানান রকম অটোমোবাইল ম্যাগাজিন তাকে উপহার দিতেন। এই ম্যাগাজিনগুলোই তুষারকে ধীরে ধীরে একজন রেসার হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখাতে থাকে।

২০০৪ সালে এরকমই একটা ম্যাগাজিন দেখতে দেখতে একটা আর্টিকেলে তার চোখ আটকে গেল। ‘ওয়ার্ল্ড সাইবার গেমস’ ভার্চুয়াল রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায়! যেহেতু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন তাই তার পক্ষে সেবার এই ভার্চুয়াল রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

কিন্তু যখনি তিনি হল ছেড়ে দিলেন, পরের বারের ভার্চুয়াল রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতার একদম প্রথম রাউন্ড থেকেই তিনি বাদ হয়ে গিয়েছিলেন। এই হেরে যাওয়া নিয়ে তার সহপাঠী এবং অংশগ্রহণকারীরা ঠাট্টা মশকরাও করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার এই হার একদমই মেনে নিতে পারেন নি।

তুষার বলেন, ‘সেইদিনই আমি সংকল্প করেছিলাম যে আমি একদিন আসল রেস জিতবই জিতব’!

আর এভাবেই একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সঠিক অনুপ্রেরণা পেয়ে ঢুকতে শুরু করলেন ফর্মুলা রেসিং এর গতিময় জীবনের দিকে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই ছোট করে দেখেন, কিন্তু তুষার প্রমাণ করেছেন সঠিক সুযোগ এবং দিক নির্দেশনা পেলে তারাও বিশ্বের সাথে সমান গতিতে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন।

বিজয়ের পথে যাত্রা

তুষারের জন্য রেসার হয়ে রেস জিতবার পথটা মসৃণ ছিল না। পরবর্তী বছরগুলোতে তুষার ধীরে ধীরে একজন রেসার হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

রেসার হবার স্বপ্ন নিয়ে তুষার তখন ফ্যান্টাসি কিংডমে অনুষ্ঠিত, গো কার্ট রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেছিলেন। যেহেতু আমাদের দেশে রেসিং-এর জন্য পর্যাপ্ত এবং সুবিধাজনক কোন জায়গা ছিল না, তাই তুষারের পক্ষে এর বেশি করার কিছু ছিলোও না।

ফ্যান্টাসি কিংডমের এই রেসিং যদিও মানুষের কাছে শুধুই নিছক বিনোদনের একটা অংশ। কিন্তু আমার কাছে তা ছিল ফর্মুলা রেসার হবার প্রথম ধাপ। তাই আমি আমার হাতের কাছে যা পেয়েছি তাই নিয়েই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি।

এই রেসিং প্রতিযোগিতায় একদম প্রথমবার অংশ নিয়েই তিনি ৩য় স্থান অধিকার করেছিলেন। যদিও তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা অনুশীলন কিছুই ছিল না।

এরপরই তুষারের বাবা মা তুষারের রেসার হবার স্বপ্নের কথা জানতে পেরেছিলেন। রেসার হওয়াটা তুষারের যে শুধুই স্বপ্ন তা নয়, এটা তার প্যাশনের জায়গা।

এরপরই হঠাৎ একদিন তিনি ভারতের ‘ফেডারেশন মোটর স্পোর্টস ক্লাব ইন্ডিয়া’ সম্পর্কে জানতে পান, এই ক্লাবে উঠতি রেসারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই খবর জানার পরই তিনি এই ক্লাবটির কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। অনেকটা পাগলাটে উপায়েই তিনি এই ক্লাবে চিঠি দিয়েছিলেন যেন তার পাগলামি এবং স্বপ্ন সম্পর্কে ধারণা পায়।

সৌভাগ্যবশত তুষারের পাগলামি কাজে লেগে গিয়েছিল। ভারতের ক্লাবটির প্রধান নির্বাহীর কাছ থেকে তিনি একটি চিঠি পেয়েছিলেন। সেই চিঠিতে লিখা ছিল – নতুন রেসারদের প্রশিক্ষণের সেশন আগামী দু এক মাসের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে।

রেসিং শেখার একটা পথ তো পাওয়া গেল। কিন্তু তার বাবা মার কাছ থেকে ভারতে যাওয়ার অনুমতি পেতেও তার বেগ পেতে হয়েছিল।

তুষার বলেন,

আমার বাবা-মা জানতেন আমার মধ্যে রেসিং এর পাগলামি আছে। যেহেতু রেসিং করতে হলে গতি এবং দুর্ঘটনার সাথে জড়িত হতে হবে, তাই আমার বাবা মা প্রথমদিকে আমার  ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু চিন্তাভাবনা করে দেখলেন বাংলাদেশে রেসিং করার চাইতে ভারতে রেসিং শিখতে যাওয়া আমার জন্য অধিক নিরাপদ।

তুষারের ফর্মুলা রেসার হয়ে ওঠা

ভারতের রেসিং প্রশিক্ষণ ক্লাবে অংশ নেয়ার পর সেই ক্লাবের প্রধান নির্বাহী তুষারকে ফর্মুলা ফোর রেসার হিসেবে রেসিং শুরু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

ফর্মুলা রেসিং এর একেবারে বেসিক স্তর হচ্ছে ফর্মুলা ফোর। ফর্মুলা ফোর থেকে শুরু করে উপরের দিকে ফর্মুলা ওয়ান হচ্ছে একেবারে সর্বোচ্চ স্তর। ফর্মুলা ফোর রেসার থেকে একজন রেসারের ফর্মুলা ওয়ান রেসার হতে হলে কখনো কখনো ১০ বছর সময় ও লেগে যেতে পারে।

শুধু সময় তো না। এই প্রোগ্রামে ট্রেনিং এবং রেসিং খেলতে অনেক টাকার দরকার হয়। গাড়ি লাগে। সরঞ্জাম লাগে। এতকিছু কেনার সামর্থ্য তুষারের পরিবারের পক্ষে ছিল না। তাই বেসিক লেভেল থেকেই রেসিং শুরু করেছিলেন তিনি। তার লক্ষ ছিল এই বেসিক স্তরে যদি কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেন তাহলে হয়ত সবার নজরে আসতে পারেন। যা তাকে পরের স্তরে যেতে সাহায্য করবে।

কিন্তু নানা চরাই উৎরাই এর পর ২০১২ সালে তুষারের স্বপ্ন সত্যি হতে শুরু করে। তার পরিকল্পনা কাজে এসেছিল। ২২ তম রেসার হিসেবে শুরু করে এক ধাক্কায় তিনি ১৫ তম অবস্থানে চলে যান। ভারতের এই রেসিং প্রতিযোগিতায় তাকে ‘বাংলাদেশি নারায়ন কার্ত্তিকায়ন’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। নারায়ন কার্ত্তিকায়ন ছিলেন ভারতের কিংবদন্তী ফর্মুলা ওয়ান রেসার।

এই অভাবনীয় পরিচিত এবং সাফল্য নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। অনেক চেষ্টা করে স্পন্সরশীপ জোগাড় করেন। এবং স্পন্সরশীপ নিয়ে তিনি আবার ভারতে যান রেসিং চালিয়ে যেতে। পরের বছরও তিনি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ভারতের রেসিং ট্র্যাকে রেস দিয়ে এসেছিলেন।

আগামীর স্বপ্ন ও স্বপ্নের পথচলা

যেকোনো স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক বাঁধা আসে। তুষারকে শুধুমাত্র রেসিং প্রশিক্ষণের জন্য দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে যেতে হয়েছিল। আমাদের দেশে রেসিং স্পোর্টসকে জনপ্রিয় করতে হলে বড় রেসিং ট্র্যাক তো লাগবেই তার পাশাপাশি দরকার সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা।

তুষার এখনকার তরুণ সমাজ নিয়ে বেশ আশাবাদি এবং চিন্তিতও। এইসব গাড়ি এবং রেসিংপ্রেমী তরুণরা ঢাকা শহরের রাস্তায় রেসিং করছে। তবে তারা সঠিকভাবে রেসিং স্পোর্টেসের দিকে এগুতে পারছে না কারণ আমাদের দেশে সেরকম কোন সুযোগ সুবিধা নেই। নেই কোন প্রশিক্ষণ।

তুষারের স্বপ্ন এই দেশের তরুণদের জন্য তিনি একটা রেসিং ট্র্যাক বানাবেন। আমাদের দেশে ফর্মুলা রেসিং শুরু এবং জনপ্রিয় করার পেছনে এটিই তার প্রথম সূত্র হিসেবে ধরে নিয়েছেন তিনি। এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

যেহেতু তুষার একজন রেসার হিসেবে যে সময়ে তার রেসিং প্রফেশন শুরু করার কথা ছিল তার থেকেও অনেক পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন এবং দেরিতে রেসিং শুরু করেছিলেন। তাই তিনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি চান তার মতো স্বপ্ন দেখা তরুনরা যেন তার মতো পিছিয়ে না পড়েন।

যদিও তুষারের এখনো আরো অনেক রেস জিততে হবে। জয়ের পথে তিনি অনেক বিপত্তি উৎরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। যাতে তিনি রেসিং ট্র্যাকে নিজের নামটি আরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

বর্তমান সময়ে গাড়ি বা ফর্মুলা রেসিং শুধু ভিডিও গেমসের  মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন তরুনদের প্যাশনে রূপ নিতে শুরু করেছে। অসম্ভবকে সম্ভব করার বাসনা নিয়ে অনেকেই এখন ফর্মুলা রেসার হবার স্বপ্ন দেখছেন।

আর তাই এখনো তুষার তার গাড়ির স্পিডমিটারের সামনে বসে, তার সংকল্পকে আরো দূরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন।

    গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী সম্পর্কে জানতে

    Share your vote!


    এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
    • Fascinated
    • Happy
    • Sad
    • Angry
    • Bored
    • Afraid

    মন্তব্যসমূহ

    Scroll to Top