প্রথমেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে নিন এই ভেবে যে, এই আধুনিক সময়ে আপনাকে 1948 এমজি টিসি রোডস্টার বা 1984 সালে তৈরি ইতালিয়ান ফেরারী 308 জিটিবি মডেলের, মান্ধাতার আমলের গাড়িগুলো ব্যবহার করতে হচ্ছে না। কেননা, এই গাড়িরগুলোর হেডলাইটে আলো ছিল খুবই মৃদু প্রকৃতির। অন্ধকার রাস্তায় এই গাড়ির হেডলাইট ব্যবহার করে খুব বেশিদূর দেখাও যেত না। আবিষ্কারের পর এই নগণ্য আলোর গাড়ির হেডলাইট কালের বিবর্তনে ধাপে ধাপে এতটাই উন্নত হয়েছে যে, এর ইতিহাস সম্পর্কে গাড়ি প্রেমিকদের কিছুটা ধারণা থাকা উচিৎ!
তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক গাড়ির হেডলাইট কীভাবে আবির্ভাব, আবিষ্কার হল। এবং গত একশ বছর ধরে এর উপরে কী পরিমাণ গবেষণা চালানো হয়েছে এবং এর উন্নতি সাধনে কারা কীভাবে ভূমিকা রেখে গেছেন। এছাড়াও কিছু হেডলাইট প্রতুস্তাকরক কোম্পানির কথাও আমরা জেনে নিব এই আর্টিকেলে!
প্রথম হারিকেন হেডলাইট
গাড়ির ইতিহাসে সবচাইতে পুরোনো হেডলাইট ছিল একটি লন্ঠন বা হারিকেন । ১৮৮০ সালের শেষ দিকে এসিটিলিন বা তেলের মাধ্যমে জ্বালানো এই হেডলাইট আবিষ্কৃত হয়েছিল। নিরবচ্ছিন্ন আলো ছড়ানোর ক্ষমতা ছিল বলে এই এসিটিলিন ল্যাম্প বা হারিকেন, গাড়ির হেডলাইট হিসেবে আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বাতাস এবং বৃষ্টির মধ্যেও এই আলো গাড়ির মাথায় জ্বালিয়ে পথ চলা যেত। এর ১০ বছর পর ইলেকট্রিক হেডলাইট বাজারে আসলেও প্রযুক্তিগত ভাবে তা এতটা উন্নত ছিল না বলে উনিশ শতকের শেষ দিকে এই লণ্ঠন বা হারিকেন টাইপ হেডলাইটই ছিল মূল ভরসা।

প্রিস্ট-ও-লাইট এবং করনিং কনোফোরের মতো কোম্পানি এই হারিকেন হেডলাইটকে আরো জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তেলে চালিত এই হেডলাইট গাড়ির একটি মূল্যবান অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছিল। হারিকেন হেডলাইট যেহেতু তেলে চলে, তাই এর জ্বালানি হিসেবে পর্যাপ্ত তেল স্টোরেজের একটা পথ আবিষ্কার করেছিলো প্রিস্ট-ও-লাইট কোম্পানি।
প্রথম দিকে গাড়ির ভেতর বসে এই হ্যারিকেন হেডলাইটের আলো বাড়ানো কমানোর ব্যবস্থা না থাকলেও, পরবর্তীতে গাড়ির অভ্যন্তরে একটি সুইচ স্থাপন করে এই হেডলাইট নিয়ন্ত্রনের একটা উপায়ও বের হয়ে গিয়েছিল। এরপর করনিং কনোফোর এই হারিকেন হেডলাইটকে আরো উন্নত করে এর ফোকাসিং এবং রিফ্লেক্টিং ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে। ১৯১৭ সালের মধ্যে করনিং কোম্পানির তৈরি ল্যান্টার্ন বা হারিকেন হেডলাইট গাড়ির থেকে ৫০০ ফুট দূরের রোডসাইন আলোকিত করার ক্ষমতা পেয়ে যায়!

ইলেকট্রিক হেডলাইট আবিষ্কার
ইলেকট্রিক হেডলাইটের আবিষ্কারের জন্য প্রথমেই যা দরকার ছিল তা হচ্ছে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার। টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৯ সালে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করলেও, গাড়ির হেডলাইট নামক যন্ত্রে, বৈদ্যুতিক বাতির ছোঁয়া লাগতে আরো ২০ বছরের মতো বেশি সময় লেগে যায়। কলম্বিয়া ইলেকট্রিক কারের মাধ্যমে ১৮৯৮ সালে ইতিহাসের প্রথম বৈদ্যুতিক হেডলাইট আত্মপ্রকাশ করে। এই ইলেকট্রিক গাড়ি কোম্পানি বিকল্প হেডলাইট হিসেবে অল্প ক্ষমতার এই হেডলাইট গাড়িতে যুক্ত করেছিলো। তবে বাজারে আসার পর এটি তেমন একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি দুটো সমস্যার কারণে। প্রথমত, এই লাইটের ফিলামেন্ট বেশিক্ষণ ধরে জ্বলে থাকতে পারতো না। আর দ্বিতীয়ত, এই হেডলাইটে বৈদ্যুতিক কারেন্ট সরবরাহ করার জন্য ডায়নামো ব্যবহার করতে হতো। ছোট ডায়নামো ব্যবহার করে এই হেডলাইটে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছিল না।

গাড়ির জন্য স্ট্যান্ডার্ড হেডলাইট আবিষ্কার
লন্ঠন বা হারিকেনের হেডলাইট ১৯০৪ সাল পর্যন্ত গাড়ির হেডলাইট হিসেবে এর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছিল। এরপর ইলেক্ট্রিক্যাল বা বৈদ্যুতিক হেডলাইটের ঘনঘন উন্নতি সাধন হবার ফলে ১৯০৮ সালের মধ্যেই বৈদ্যুতিক বাতি গাড়ির জন্য স্ট্যান্ডার্ড হেডলাইট হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এরপর ১৯১২ লাসে জেনারেল মটরস কোম্পানির ক্যাডিলাক বিভাগ, গাড়ির হেডলাইটকে আরো উন্নত করার চেষ্টা চালায় এবং ডেলকো ইলেকট্রিক ইগনিশন এবং লাইটিং সিস্টেম গাড়ির সাথে যুক্ত করে। আর এরই হাত ধরে শুরু হয় আধুনিক হেডলাইটের যুগ।

১৯৪০ সালের মধ্যে আধুনিক ইলেকট্রিক সিলড বিম হেডলাইট গাড়ির জগতে বেশ ভাল একটি শক্ত অবস্থান করে নেয়। এরপর ১৭ বছর ধরে, আমেরিকান একটি আইনের পাল্লায় পড়ে হেডলাইটের উন্নতি সাধন এক প্রকার থেমে ছিল বলা যায়। আমেরিকান সরকারের একটি ট্রাফিক আইন অনুসারে গাড়িতে কমপক্ষে ৭ ইঞ্চি মাপের হেডলাইট ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। এরপর ১৯৫৭ সালে এই আইন পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং গাড়িতে যেকোনো মাপের হেডলাইট ব্যবহারের সুবিধা চলে আসে। ফলে হেডলাইট প্রযুক্তি এর বিকাশের পথে আবারো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়!
সিল বিম হেডলাইট থেকে হ্যালজেন হেডলাইট
১৯৬০ সাল পর্যন্ত ইউরোপ, জাপান এবং দক্ষিণ আমেরিকার হেডলাইট প্রস্তুকারকরা ব্যপক পরিমাণে সিল বিমড হেডলাইট বাজারজাত করেছিল। গাড়ির হেডলাইটে বৈদ্যুতিক সিল বিম বাতির প্রায় ৫০ বছরের রাজত্ব শেষে বাজারে আসে হ্যালোজেন বাতি। এরপর শুরু হয় হ্যালোজেন হেডলাইটের রাজত্ব। সিলড বিম এবং সিঙ্গুলার হেডলাইট- উভয়ক্ষেত্রেই হ্যালোজেন হেডলাইট জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে।

হেডলাইটের জগতে হ্যালোজেন বাল্ব এখনও নিজ আলোয় দীপ্যমান। কিন্তু এই হ্যালোজেন বাতির উন্নতি সাধনেও রয়েছে প্রযুক্তির উন্নয়নের ছোঁয়া। প্রথমদিকে বৈদ্যুতিক বাতির ফিলামেন্ট, নাইট্রোজেন-আর্গন গ্যাসের একটি প্রকোষ্ঠে রেখে জ্বালানো হতো। কিন্তু হ্যালোজেন বাতিতে ফিলামেন্ট আরো উন্নত হয়ে ট্যাঙ্গস্টান ফিলামেন্ট প্রযুক্তি যুক্ত হলো। এই ট্যাঙ্গস্টান ফিলামেন্টকে আয়োডিনের গ্যাস চেম্বারে রেখে জ্বালালে অনেক বেশি আলো পাওয়া যেত। এরপর আয়োডিনকে সরিয়ে এলো ব্রোমিনের ফিলামেন্ট চেম্বার। ব্রোমিন গ্যাস ব্যাবহারের ফলে আরো অধিক সময় ধরে, অথিক পরিমাণ আলো পাওয়া যেত হ্যালোজেন হেডলাইটে। যা হ্যালোজেন বাতিকে আরো মানসম্পন্ন করে তুলতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। গত ৬০ বছর ধরে গাড়ির হেডলাইট হিসেবে হ্যালোজেন বাতি গাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
এলইডি হেডলাইট
এখন আমাদের হাতে আছে এলইডি বা লাইট এমিটিং ডায়োড। যা হ্যালোজেন বাতির চাইতে অনেক বেশি সময় ধরে আলো দেয় এবং আরো অনেক দূর পর্যন্ত এর আলো পৌছাতে পারে। ২০০৪ সাল নাগাদ এলইডি বাল্বের হেডলাইট বাজারে আসে। অডি এ৮ মডেলের গাড়িতে প্রথম এলইডি হাডলাইটের দেখা পাওয়া যায়।

আগামীতে লেজার হেডলাইট?
গত অর্ধ শতক জুড়ে গাড়ির হেডলাইটে হ্যালোজেন লাইটের আধিপত্য থাকার পরেও, আগামীতে কোন প্রযুক্তি সবচাইতে বেশি কাজে দিবে তা নিয়ে এখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন। কারণ দিন যত যাচ্ছে প্রযুক্তির সাথে সাথে আমাদের সবকিছুই আরো উন্নত হচ্ছে। তাই বাদ যাচ্ছেনা গাড়ির হেডলাইটও! বিজ্ঞানীরা আশা করছেন আগামীতে গাড়িতে যুক্ত হবে লেজার হেডলাইট।

গাড়িতে হেটলাইটের ইতিহাস তো জানা হলো। গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকারের ইতিহাস কি আপনার জানা আছে? জানলে জেনে নিতে পারেন এখানে ক্লিক করে।