প্রহরী

ড্রাইভার রাখার আগে জানুন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
পড়তে লাগবে: 4 মিনিট

ড্রাইভার রাখার আগে জানুন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থায় সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো নিরাপত্তা। প্রতিদিনই সড়কে দুর্ঘটনাতে অসংখ্য মানুষ মারা যান বা আহত হন। চট্টগ্রাম বা ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে প্রতিদিন অফিস, পারিবারিক কাজ বা ব্যবসার জন্য অনেকেই ড্রাইভার রাখেন। কিন্তু একজন ড্রাইভারের ওপরই নিরাপদ ভ্রমণ, মানসিক শান্তি আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নির্ভর করে। তাই একজন বিশ্বস্ত ড্রাইভার খুঁজে পাওয়া খুবই জরুরি।

তবে প্রশ্ন হলো-কীভাবে বুঝবেন একজন ড্রাইভার সত্যিই কি বিশ্বস্ত? উত্তরটা সহজ- ভালোভাবে ড্রাইভারের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা। এই ব্লগে আমরা ধাপে ধাপে দেখাব কীভাবে একজন ড্রাইভারের বিশ্বস্ততা যাচাই করবেন এবং ড্রাইভার রাখবেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।

ড্রাইভার ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই কেন গুরুত্বপূর্ণ?

১. নিরাপত্তা আগে: চালকের পেছনের কাজের তথ্য চেক করুন, এটি আপনার পরিবার বা ব্যবসার নিরাপত্তার জন্য খুব জরুরি। একটি ক্লিয়ার ড্রাইভিং রেকর্ড আছে এমন দায়িত্বশীল চালক নিয়োগ করুন। এতে নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত হবে এবং দুর্ঘটনা, কিংবা আইনি সমস্যার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।

২. সম্পদের সুরক্ষা: গাড়ি আপনার একটি মূল্যবান সম্পদ। চালককে গাড়ির পুরো অ্যাক্সেস দেওয়া হয়—ফুয়েল কার্ড, কাগজপত্র, যদি এটি বিজনেস গাড়ি হয়, তবে মালামাল এর দায়িত্বও থাকে। তাই সঠিক ড্রাইভারকে বুঝে শুনে দায়িত্ব দেওয়া জরুরি।

৩. মানসিক শান্তি: যখন আপনি কোন পরীক্ষা যাচাইয়ের এর মাধ্যমে কোনো চালককে নিয়োগ দেন, তখন আপনার মনে আত্মবিশ্বাস ও মানুষিক শান্তি থাকে। বিশেষ করে গাড়িতে যদি শিশু বা গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট থাকে, তখন এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই নিয়োগের আগে যাচাই প্রক্রিয়া জরুরী।

৪. প্রতারণা প্রতিরোধ ও ঝুঁকি কমানো: ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের মাধ্যমে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন চালকের লাইসেন্স আসল কিনা, কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড আছে কিনা বা সে বারবার ট্রাফিক আইন ভেঙেছে কিনা। এই বিষয়গুলো আগেভাগে জানা আপনাকে আইনি ও আর্থিক ঝুঁকিতে পড়তে হবে না।

৫. আইনি সুরক্ষা: যদি ভবিষ্যতে কোনো আইনি সমস্যা বা ঘটনা ঘটে, তখন প্রমাণ দেখাতে পারবেন যে আপনি নিয়োগের সময় যথাযথ যাচাই করেছেন। এটি আপনাকে এবং আপনার প্রতিষ্ঠানকে আইনি ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে।

এ কারণেই, চালক রাখার আগে ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করাটা শুধু বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বরং এক ধরনের নিরাপত্তা বিধি বলা চলে।

ড্রাইভারের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো

যদি আপনি আপনার গাড়ির জন্য একজন ড্রাইভার রাখতে চান, তাহলে নিচের বিষয়গুলো ভালোভাবে খেয়াল রাখা জরুরি:

১. পরিচয় যাচাই

ড্রাইভারের জাতীয় পরিচয়পত্র (NID), পাসপোর্ট অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাই করুন। নাম, ছবি ও জন্মতারিখ সব কাগজে একসাথে মিলে কি না দেখে নিন। নিরাপত্তার জন্য এসব কাগজের একটা কপি নিজের কাছে রেখে দিন।

২. ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাই

ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্সটি আসল এবং বৈধ কিনা তা নিশ্চিত করুন। লাইসেন্সটি মেয়াদোত্তীর্ণ নয় এবং সে যে ধরণের গাড়ি চালাবে, তার জন্য উপযুক্ত কিনা তা যাচাই করুন। বাংলাদেশে BRTA-এর ওয়েবসাইট অথবা মোবাইলের SMS সেবার মাধ্যমে এটি যাচাই করা যায়।

৩. মোটর ভেহিক্যাল রিপোর্ট

এই রিপোর্টে জানা যায় ড্রাইভার আগে কোনো ট্রাফিক আইন ভাঙছে কি না বা লাইসেন্স সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। এটি ড্রাইভারের নিরাপদ চালনার ইতিহাস বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৪. পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ও অপরাধমূলক পটভূমি যাচাই

যদি আপনি ফুলটাইম বা দীর্ঘমেয়াদে ড্রাইভার রাখতে চান, তাহলে তাকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে বলুন। এই সার্টিফিকেট প্রমাণ করে ড্রাইভার কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিনা। বাংলাদেশে এটি সাধারণত ড্রাইভারের স্থায়ী ঠিকানার থানার মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায়।
এই প্রক্রিয়াটি কয়েকদিন বা এক-দুই সপ্তাহ সময় নিতে পারে, তবে এটি আপনার নিরাপত্তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

৫. আগের চাকরির তথ্য যাচাই

ড্রাইভারের আগের মালিকদের থেকে রেফারেন্স চাইতে পারেন। তিনি আগে কোথায় কাজ করতেন, কতদিন কাজ করেছেন, দায়িত্ব ও আচরণ কেমন ছিল, কেন চাকরি ছেড়েছেন—এসব জানলে আপনি তার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাবেন।

৬. ঠিকানা যাচাই (Address Check):

ড্রাইভারের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা লিখে রাখুন। সম্ভব হলে বর্তমান ঠিকানায় একবার গিয়ে দেখে আসুন অথবা বিদ্যুৎ বিল, ভাড়ার চুক্তিপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে ঠিকানাটি যাচাই করুন। এতে ড্রাইভারের ওপর আপনার নজরদারি সহজ হবে।

৭. ড্রাগ টেস্ট চেক করুন

ড্রাইভার নিয়োগের আগে তার ড্রাগ টেস্ট করানো ভালো। এতে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন তিনি নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন কিনা। আপনার পরিবার বা অফিসে কাজ করার সময় মদ বা কোনো মাদক গ্রহণ করা যাবে না-এই নীতিটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিন। এতে যাত্রী ও গাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং পেশাদার পরিবেশ বজায় থাকে।

৮. স্বাস্থ্য ও শারীরিক ফিটনেস

একজন ভালো ড্রাইভারের জন্য শারীরিকভাবে ফিট থাকা খুব জরুরি, কারণ তাকে দীর্ঘ সময় গাড়ি চালাতে হয় এবং অনেক সময় জ্যাম বা চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আপনি চাইলে ড্রাইভারের একটি সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট চাইতে পারেন, বিশেষ করে যদি সে ফুলটাইম কাজ করে বা লং-ডিস্ট্যান্স (দূরপাল্লার) যাত্রা করে। ড্রাইভারের কোনো গুরুতর শারীরিক সমস্যা আছে কিনা—যেমন চোখের সমস্যা, মৃগী রোগ, বা নেশার অভ্যাস—তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কারণ এসব সমস্যা চালনার সময় বিপদ ঘটাতে পারে।

৯. সহজ কিছু যাচাই পদ্ধতি

বিশ্বাসযোগ্য একজন ড্রাইভার নিয়োগ দিতে চাইলে, কিছু সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন। একটা জিপিএস ট্র্যাকার বা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে ড্রাইভারের চালানোর ধরন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। ইন্টারভিউয়ের সময় জিজ্ঞাসা করুন—তার ড্রাইভিং অভিজ্ঞতা, রুট চেনা ইত্যাদি বিষয়ে।
একটি লিখিত চুক্তি করুন, যেখানে তার দায়িত্ব, বেতন ও নিয়মাবলী পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকবে।

শুরুর দিকে এক মাসের জন্য ট্রায়াল ভিত্তিতে রাখুন, দেখুন সে সময়মতো আসে কিনা ও নিরাপদভাবে চালায় কিনা। ড্রাইভার নিয়োগের পর তার কাজের পারফরম্যান্স নজরে রাখুন এবং কোনো সমস্যা হলে দ্রুত সমাধান করুন।

১০. কিছু সতর্কতামূলক বিষয় (Red Flags)যা খেয়াল রাখা উচিত:

সাবধান হোন যদি ড্রাইভার-

  • পরিচয়পত্র দেখাতে রাজি না হয়,
  • আগের চাকরি নিয়ে সন্দেহজনকভাবে কথা বলে বা রাগ দেখায়,
  • নেশার কোনো লক্ষণ দেখা যায়,
  • যাচাইয়ের প্রক্রিয়া এড়িয়ে যেতে চায়,
  • বা গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলে বা দুর্ব্যবহার করে।

এগুলো তার অযোগ্যতা বা নিরাপত্তার ঝুঁকি বোঝাতে পারে।

১১. সন্দেহজনক বিষয় যা করবেন

যদি আপনার ড্রাইভারের আচরণে কিছু সন্দেহজনক বা অসততা দেখতে পান, তাহলে বিষয়টি অবহেলা না করে সাথে সাথে খোঁজ নিয়ে দেখুন। যদি বিষয়টি গুরুতর হয়-যেমন চুরি, হুমকি বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা-তাহলে নিকটস্থ থানায় জানিয়ে দিন এবং ড্রাইভারের যাবতীয় তথ্য দিন। এছাড়া, আপনার অভিজ্ঞতা স্থানীয় কমিউনিটি গ্রুপ বা অ্যাপে শেয়ার করলে অন্যরাও সতর্ক থাকতে পারবে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার ঝুঁকি কমবে।

শেষ কথা

ড্রাইভার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেওয়া উচিত নয়। তিনি আপনার পরিবারের নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত সময় আর ব্যবসার সঙ্গেই জড়িত থাকেন। সঠিকভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করলে আপনি ভবিষ্যতে অনেক ঝামেলা থেকে রেহাই পাবেন।

বিশ্বাস গড়ে ওঠে সততা ও নিয়মিত আচরণের মাধ্যমে। তাই শুরু থেকেই সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করুন। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে অনেক সময় যাচাই ছাড়াই লোক নিয়োগ হয়, সেখানে এই সচেতনতা আরও জরুরি। নিজেকে, পরিবারকে আর গাড়িকে সুরক্ষিত রাখুন-সতর্ক থাকুন, আত্মবিশ্বাসের সাথে চলুন।

    গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী সম্পর্কে জানতে

    Share your vote!


    এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
    • Fascinated
    • Happy
    • Sad
    • Angry
    • Bored
    • Afraid

    মন্তব্যসমূহ

    Scroll to Top