যুগে যুগে এগিয়ে চলছে মানুষ। প্রতিনিয়ত মানুষ আবিষ্কার করছে নতুন কিছু । চাকা থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ পর্যন্ত সবই ছিল মানুষের এগিয়ে যাবার এক একটি ধাপ। শুরুতে মানুষ যে গাড়ি ব্যবহার করতো তা কালের বিবর্তনে পুরোপুরি বদলে নতুন হয়েছে। যোগ হয়েছে আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রাংশ। মানুষ তার সুবিধা ও আরাম বাড়ানোর জন্য সব ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। এখনো গাড়ি তৈরির বড় বড় কারখানাগুলো কাজ করে চলছে নতুন কিছু আবিষ্কারের আশায়। কিছু প্রযুক্তি এতোটাই চমকপ্রদ আর বিস্ময়কর যে সাবাই চাইবে সেগুলো নিজের গাড়িতে সংযোজন করতে। আসুন দেখে নেই কোন কোন প্রযুক্তি ভবিষ্যতে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির চেহারা পাল্টে দিতে পারে!
১. ভেহিক্যাল টু ভেহিক্যাল কমিউনিকেশন
আমেরিকান গাড়ি নির্মাতারা এবং সরকার চিন্তা ভাবনা করছে কীভাবে গাড়িগুলোকে আরেকটু প্রযুক্তি সম্পন্ন করে তোলা যায়। তারা ভাবছে ভবিষ্যতে গাড়িগুলোতে দুটি প্রযুক্তির ব্যবহার থাকবে একটি হচ্ছে পাশাপাশি চলা দুটি গাড়ি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারবে আরেকটি কোন বস্তু আদান প্রদান করতে পারবে। মনে করুন, কোন গাড়িতে লাল লাইট জ্বালিয়ে সংকেত দেয়া হলো। আপনি বুঝতে পারলেন না কিন্তু আপনার গাড়ি সংকেত পেয়ে বুঝে গেল । এবং গাড়িটি নিজে থেকেই ব্রেক করল । এভাবেই কোন বড় দুর্ঘটনা ঘটা থেকে বেঁচে গেলেন আপনি এবং আপনার গাড়ি। এই ধরনের প্রযুক্তিকে বলে ভেহিক্যাল টু ভেহিক্যাল কমিউনিকেশন (V2V) বা গাড়ির সাথে গাড়ির যোগাযোগ। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় গাড়ি ফোর্ড গাড়ির নির্মাতারা এই প্রযুক্তিটির পরীক্ষা করে দেখছে । কীভাবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার করে রাস্তায় দুর্ঘটনা কমানো যায় তা সম্পর্কেও তারা ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা করছে। শুধুমাত্র ভেইক্যাল টু ভেইক্যাল কমিউনিকেশনের পাশাপাশি তারা ভেইক্যাল টু ইনফ্রাস্ট্রাকচার (V2I) কমিউনিকেশন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে গাড়ি তার চারপাশের বস্তুর সাথেও যোগাযোগ করতে পারবে এবং নিজে নিজেই চলার পথের বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা নির্ণয় করতে পারবে।
২. সেলফ ড্রাইভিং কার
সেলফ ড্রাইভিং কার নতুন কোন প্রযুক্তি নয়। অনেক মুভি, টিভি শো বানানো হয়েছে এই সেলফ ড্রাইভিং কার নিয়ে। এমনকি আমরা রাস্তায় গাড়ি নিজে নিজে পার্ক করার ব্যাপারটিও জেনেছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেলফ ড্রাইভিং কার মানে হচ্ছে যে গাড়িটি নিজে নিজে চলতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া ও নেভাডাতে গুগোল ইঞ্জিনিয়াররা সেলফ ড্রাইভিং কার নিয়ে রাস্তায় ২০০,০০০ মাইল পরীক্ষা করেছেন। গুগোলের গাড়িগুলো রাস্তার ছবি তুলে সংরক্ষন করে রাখে। এছাড়া রাস্তার ম্যাপ, ট্রাফিক লাইট, রুট ইত্যাদি সব গাড়ির মধ্যে কম্পিউটারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। লেসার, রাডার এবং ক্যামেরার সাহায্যে সেলফ ড্রাইভিং কারগুলো প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে চালানো হয় , যা একজন মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সেলফ ড্রাইভিং কারগুলো জনসাধারনের হাতের নাগালে আসতে হয়তো আরেকটুঁ সময় নিবে। আমেরিকানরা বছরে গড়ে প্রায় ১০০ ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকে। যে গাড়িগুলো এভাবে নিজে চলে সেগুলো যদি প্লাটুনিং করে চলে তাহলে কিছুটা হলেও দুর্ঘটনা কমবে । প্লাটুনিং অর্থ হচ্ছে অনেকগুলো গাড়ি একসাথে একই গতিতে চলা।
৩. অগমেন্টেড রিয়েলিটি ড্যাশ বোর্ড
গাড়ি চালানোর সময় আমরা অনেকেই জিপিএস এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত সুবিধা ব্যবহার করে থাকি । নতুন কোন জায়গায় ভ্রমনে গেলে এসব প্রযুক্তি খুব কাজে দেয়। কিছু উন্নত প্রযুক্তির গাড়িতে এই প্রযুক্তিটি গাড়ির উইন্ড শীল্ডে লাগানোর চিন্তা করা হচ্ছে । সুদূর ভবিষ্যতে গাড়ির সামনে থেকে আসা বস্তু সম্পর্কে চালককে তথ্য দেওয়া হবে। চালক সেসব তথ্য গাড়ির উইন্ড শীল্ডে দেখতে পাবে।
টারমিনেটর মুভির কথা নিশ্চই সবার মনে আছে। কীভাবে রোবট কোন কিছুর দিকে তাকায় এবং সব তথ্য সংগ্রহ করে ফেলে। অগমেন্টেড রিয়েলিটি ড্যাশ বোর্ড ব্যাপারটিও ঠিক তেমনি কাজ করবে। সংক্ষেপে এই প্রযুক্তিকে AR বলা হয়ে থাকে। এই প্রযুক্তি আপনাকে রাস্তার ম্যাপ, লেন এমনকি কোন জায়গা থেকে গাড়ি ঘুরাতে পারবেন সেটাও হাইলাইট করে দেবে।
বিএমডাব্লিউ গাড়িগুলো গাড়ির টেকনিশিয়ানদের জন্য তৈরি করছে আরেক চমক। উইন্ড শিল্ডে একটি ক্যামেরা থাকবে। যার মাধ্যমে দেখতে পাবেন গাড়ির ইঞ্জিনের কি অবস্থা, গাড়ির ইঞ্জিনের কোন অংশের মেরামত প্রয়োজন বা পাল্টানো প্রয়োজন। এবং কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন ধাপে ধাপে দেখানো হবে উইন্ড শিল্ডে। কি হবে না খুব চমৎকার ব্যাপার?
টয়োটা এরকম একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। যার মাধ্যমে যাত্রী গাড়ির জানালায় টাচ করে পাশে থাকা বস্তুটিকে জুম করে দেখতে পারবে। যদিও এখনো এই প্রযুক্তির একটিও বাস্তবায়ন হয়নি, তবে এগুলো নিয়ে বড় গাড়ি নির্মাতারা কাজ করে যাচ্ছে ।
৪. ব্রেকিং এয়ারব্যাগ
যখন থেকে এয়ারব্যাগের আবিষ্কার করা হয়েছে তখন থেকেই এয়ারব্যাগ প্রতিনিয়ত আপগ্রেড হয়ে চলছে। এখন গাড়ির প্রায় সব অংশেই এয়ারব্যাগের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সীটের নিচে, হাঁটুর সামনে, জানালার নিচে, এমনকি সীট বেল্টের ভেতর সব জায়গায় এয়ারব্যাগের সিস্টেম থাকছে। হয়তো সব গাড়িতে এখনো পুরোপুরি এয়ারব্যাগ দেখা যায়না কিন্তু মোটামোটি সব গাড়িতেই বিভিন্ন ভাবে এয়ারব্যাগের সংযোজন দেখা যায়। মার্সিডিস গাড়ির নির্মাতারা চেষ্টা করছে নতুন প্রযুক্তির এয়ারব্যাগ বানানোর। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এয়ারব্যাগটি ঠিক সে জায়গা থেকেই বের হবে যে জায়গাটিতে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। তারা চেষ্টা করছে যাতে এয়ারব্যাগটি দুর্ঘটনার সময় গাড়ি থামিয়ে দেয় । এয়ারব্যাগ ঘর্ষণের মাধ্যমে গাড়ির ইঞ্জিনের পাওয়ার কমিয়ে গাড়িকে থামিয়ে দেবে এমন কিছু একটা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে মার্সিডিস কারের নির্মাতারা। কয়েক বছর ধরেই মার্সিডিস নির্মাতারা এই প্রজেক্টে কাজ করে চলছে। দেখা যাক , কতদিনে এই প্রযুক্তি আমরা রাস্তায় দেখতে পাব ।
৫. শক্তি সঞ্চয়কারী বডি প্যানেল
এক্সন মোবিল হচ্ছে আমেরিকার একটি অন্যতম বড় তেল ও গ্যাসের কোম্পানি। এক্সন মোবিল থেকে একটি গবেষণা করে বলা হয়েছে , আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে সব গাড়ি হাইব্রিড গাড়িতে পরিণত হয়ে যাবে। প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য অবশ্যই এটি একটি সুখবর কিন্তু হাইব্রিড গাড়ির ব্যাটারি অনেক ভারী হয় এবং রাখতে অনেক জায়গা লাগে। এমনকি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিগুলোর ওজন অনেক বেশী হয়। আর এই কারনে বাজারে আসছে শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে পারে এমন বডি প্যানেল যুক্ত গাড়ি।
আগুন মানুষের সেবা দিয়ে থাকে আবার আগুনই আবার মানুষের জীবন পুড়িয়ে দিতে পারে। ঠিক তেমনি প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করলে কখনোই সেটা অভিশাপ প্রমাণ হবেনা। প্রযুক্তি যখন আমাদের রন্ধ্রে- রন্ধ্রে মিশে আছে তাহলে কেনই বা তার সঠিক ব্যবহার করবো না ? প্রতিটি প্রযুক্তির সিংহভাগ ব্যবহার এখন আশীর্বাদরুপে ভূমিকা রাখছে।